Ticker

6/recent/ticker-posts

Kantara- A Legend

 2022 শুরু হয়েছিলো কাশ্মীর ফাইলস দিয়ে যা ভারতীয় সিনেমাকে  এক নতুন রাস্তা দেখিয়েছিলো বলা যায়।  তারপর এলো  RRR , বাহুবলীর পর এস.এস.রাজামৌলি আরও একবার ভারতীয় সংস্কৃতির গৌরব গাথা পর্দায় আনলেন। এবার 'কান্তারা ' যা এক আশ্চর্য্য সৃষ্টি ভারতীয় সিনেমার ক্ষেত্রে।

ছবির মূল ভাষা 'কন্নড়' হলেও এটি হিন্দি, তামিল, তেলেগু ভাষাতেও মুক্তি পেয়েছে। ছবির লেখক, পরিচালক, প্রযোজক এবং নায়ক ঋষভ শেট্টি নিজেই। এছাড়াও অন্যান্য মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন  সপ্তমী গৌড়া, কিশোর, মানসী সুধীর, স্বরাজ শেট্টি, অচ্যুত কুমার প্রমুখ।  

ছবির প্রেক্ষাপট শুরু হয় ১৮৪৭ সালের এক ঘটনা দিয়ে, সেই সময়ের কর্ণাটকের এক রাজা যার স্ত্রী , সন্তান , সম্পত্তি, ভালো প্রজা সব থাকা সত্ত্বেও মনে শান্তি ছিলো না. তিনি সেই হতাশায়  ঘুরতে ঘুরতে দক্ষিণ কর্ণাটকের এক গ্রামে পৌঁছান। সেখানে এক শিলা খন্ড যাকে গ্রামের মানুষেরা গ্রাম দেবতা পাঞ্জুরলি বলে পুজো করেন তার সামনে গিয়ে তিনি মনে এক শান্তি অনুভব করেন। তিনি এই গ্রাম দেবতাকে তার সাথে নিয়ে যেতে চান ও তার বদলে সেই গ্রামের মানুষদের তার বিশাল বনভূমির এক অংশ প্রদান করেন। কিন্তু তাকে সাবধান করা হয় এই দান করা জমি তার উত্তরসূরিরা যেন আর ফেরত না চায়। 


এরপরের ঘটনা ১৯৭০ সাল সেই রাজার এক উত্তরসূরি সেই দৈব আদেশ অমান্য করে জমি ফেরত পাওয়ার জন্য মামলা করে কিন্তু আদালত চত্বরে সে মারা যায়। এরপরে ছবির মূল সময় কাল ১৯৯০ সাল এই কাডবিট্টু গ্রাম ও সংলগ্ন জঙ্গলকে বনদপ্তর থেকে সংরক্ষিত বনভূমি বানানোর পরিকল্পনা হয় ও মুরালিধর নামে একজন অফিসারকে সেই দায়িত্ত্ব দিয়ে গ্রামে পাঠানো হয়। গ্রামের কাম্বালা খেলোয়াড় শিবা যে তার মায়ের অবাধ্য ও সারাদিন দামালপনা করে বেড়ায় কিন্তু গ্রামের ভূতাকোলা অনুষ্ঠানের জন্য বন থেকে কাঠ ইত্যাদি কাটা নিয়ে যখন মুরালিধর গ্রামবাসীদের নিষেধ করে তখন শিবার সাথে তার শত্রুতা শুরু হয়, গ্রামের জমিদার দেবেন্দ্র যে সেই রাজার উত্তরসূরিও বটে সে শিবা ও তার দল কে সমর্থন করে।  এছাড়াও বুনো শুয়োর শিকার নিয়েও মুরালি ও শিবা ঝামেলা বাধে।  অন্যদিকে শিবার প্রেমিকা এই বনদপ্তরের অফিসে কাজে যুক্ত হয় ও বনদপ্তর থেকে একদিন গ্রামের সীমানা তৈরী করে দেওয়ার জন্য গ্রামবাসীদের গ্রাম থেকে চলে যেতে বলা হলে শিবা ও তার দলএর সাথে বনবিভাগের প্রবল যুদ্ধ হয় এবং শিবা ও তার প্রেমিকার সম্পর্ক খারাপ হয়। শিবা তার দল নিয়ে কিছুদিন লুকিয়ে থাকার পর বন বিভাগের হাতে ধরা পড়ে ও জেলে যায়। এই সময় শিবার ভাই যে ভূতাকোলা তে নৃত্য পরিবেশন করতো তার মৃত্যু হয় ও শিবা জেল থেকে ফিরলে জমিদার তাকে বলে মুরালিধর তার ভাই এর হত্যাকারী কিন্তু শিবা শেষে জানতে পারে জমিদার দেবেন্দ্র ই জমি ফেরত পাওয়ার জন্য তার ভাইকে মেরেছে। এই সময় অফিসার মুরালি গ্রামবাসীদের জানায় এই গ্রাম ও বন কে সরকারি সংরক্ষণের আওতায় আনলে তাদের জমি অন্য কেউ দখল করতে পারবে না তাই গ্রামবাসীরা যেন তাকে সাহায্য  করে।  জমিদারএর  বিরুদ্ধে বনদপ্তর ও গ্রমবাসীরা মিলিত হয়ে লড়াই করে।  ছবির শেষে শিবাকেই তার পিতার মতো ভূতাকোলাতে নৃত্য পরিবেশন করতে দেখা যায় , এতদিন শিবা এই নৃত্য করতো না কারণ সে ছোটবেলায় এই ভূতাকোলার নৃত্য শেষে তার বাবার রহস্য জনক অন্তরধান তাকে এক গভীর আঘাত দিয়েছিল। 

প্রসঙ্গত ভূতাকোলা দক্ষিণ কর্ণাটক ও কেরালার বিভিন্ন গ্রামের এক প্রাচীন উপাচার যার মাধ্যমে ভূত তথা আত্মার উপাসনা করা হয় নৃত্যের মাধ্যমে। একেক অঞ্চলে পূজিত হন একেক দৈবা। তাদের একেক রকম নাম, হরেক রকম বিচিত্র কাহিনী এবং অবিশ্বাস্য অলৌকিক শক্তি। স্থানীয় বিশ্বাস অনুযায়ী এই ভূত বা দৈবারা অধিকাংশই সাক্ষাৎ মহাদেবের অনুচর। এদের মধ্যে আন্নপ্পা পাঞ্জুরলি ( যিনি সাক্ষাৎ শুকরের রূপ ধরেন), পিল্লি চামুন্ডি ( যিনি ব্যাঘ্রের রূপ ধরেন), জুমাড়ি ( যিনি একইসঙ্গে নারী ও পুরুষ ) কিংবা গুলিগা'র( যাকে সাক্ষাৎ শিবের অনুচর মানা হয়) কাহিনী বহুলপ্রচলিত। এছাড়াও নানান দৈবার এমন অলৌকিক কাহিনী কান পাতলেই শোনা যায় কর্ণাটকের এই অঞ্চলগুলিতে।

এক দিকে বনাঞ্চলের মানুষের উপাসনা , তাদের জীবন যাত্রা অন্যদিকে বেঁচে থাকার জন্য তাদের সংগ্রাম এই সব কিছু মিলিয়ে এক সাধারণ ঘটনাকে যেভাবে উত্তেজনা ও রোমাঞ্চের সাথে পরিবেশন করা হয়েছে এক কথায় অনবদ্য। প্রত্যেকের অভিনয় খুব সাবলীল , কর্ণাটকের প্রত্যন্ত গ্রামের ঘটনা হলেও গল্পের চরিত্রদের সাথে আমরা সকলেই একাত্ম হতে পারি। প্রথম দিকে গল্প মন্থর লাগলেও ছবি যত এগোয় উৎসাহ তত বাড়তে থাকে। ছবির শেষ পর্যায় ঋষভ শেট্টি র অভিনয় আপনাকে স্তম্ভিত করতে বাধ্য যদি আপনার অভিনয় বোধ থাকে। এছাড়াও কিছু কিছু ক্ষেত্রে কমেডি দৃশ্য গুলিও দর্শককে হাসায়। এছাড়াও ক্যামেরার কাজ সুন্দর যা পর্দায় কর্ণাটকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করায় আমাদের। ছবির আরো একটি ইতিবাচক দিক অ্যাকশন দৃশ্য গুলি যা অত্যন্ত সুন্দর ভাবে বানানো হয়েছে। অধিকাংশ অ্যাকশন দৃশ্য লোকজন সমন্বিত হলে অনেক সময় পরিচালক সেটা ঠিক ভাবে করতে পারেন না এখানে পরিচালক সম্পূর্ণ সফল। ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক যথেষ্ট ভালো। কিছু ক্ষেত্রে মনে হয়েছে খুব তাড়াতাড়ি দৃশ্য পরিবর্তন হয়েছে।

শিবা চরিত্রটি ভগবান শিব কে মনে করেই বানানো হয়েছে । একদিকে শিবা মহাদেবের মতো ধ্বংসাত্মক রূপ ধরছে বুনো শুকর শিকার করছে , নেশা করছে, গাছ কাটছে অন্য দিকে গ্রামের বিপদে সেই রক্ষাকর্তা হয়ে দাঁড়াচ্ছে এবং শিবা মাঝে মাঝে যে উঁচু গাছের ওপর মাচা বানিয়ে থাকে তাকে সে কৈলাশ বলে। অফিসার মুরালির চরিত্রের মধ্যেও কিছু দিক দেখা যায় সে একদিকে কর্তব্য পরায়ণ সেজন্য সে প্রথমে সেই বনকে রিসার্ভ ফরেস্ট বানানোর দায়িত্ব পালন করার পূর্ণ চেষ্টা করে তাই গ্রামবাসি দেড় সেখান সরে যেতে বলে আবার সে যখন দেখে জমিদার এই জমি দখল এর জন্য চেষ্টা করছে তখন সে গ্রাম সহ বোন বাঁচানোর জন্য গ্রামবাসীদের সহ্য করে।

ছবির মূল বিষয় অরণ্য এই অরণ্য কারও একার না জমিদারেরও না, সরকারেরও না, আবার গ্রামবাসীদেরও না, তাই সে তার রাস্তা নিজেই করে নেয়। এই প্রকৃতি শিবা কে দিয়ে জমিদারএর পাপের শাস্তি দেয়, শিবা কে দিয়ে বলায় 'ঈশ্বর ক্ষমা করলেও আমি করবো না জমিদারকে বধ করে এই ভূমিতে ধর্মের প্রতিষ্ঠা করবো।

অনেক নির্দিষ্ট মতাদর্শের লোক এই ছবিতে কুসংস্কার কে প্রমোট করা হচ্ছে বলছে , কিন্তু যে বিশ্বাস মানুষকে বেঁচে থাকার শক্তি দেয় , মানসিক শান্তি দেয় সেই বিশ্বাস কখনও কুসংস্কার হতে পারে না। নিৰ্দিষ্ট মতাদর্শের বাইরে গিয়ে কোনো জিনিসকে কেউ যখন দেখতে পারেনা কুসংস্কার সেটাই।

ভারতের একটি সংস্কৃতিক দিক, তার সাথে পুরাণ ও লোক কথার মিশেলে এই ছবি এক অদ্ভুত সুন্দর অভিজ্ঞতা।

রেটিং -৯.৫/১০


Post a Comment

0 Comments